Sunday, May 12, 2013

ভালোবসা

Leave a Comment
মনে আছে তোর ভাই সেইদিন মেঘলা রাতে হঠাৎ করেই ছুটে এসে বলেছিলি, 'ভাইয়া ভাইয়া, ভুত, ভুত…ওইখানে ভুত দেখেছি…ভয় লাগছে আমার খুব' এবং সেদিন রাতে তোর ছোট্ট দেহটা জড়িয়ে রেখেছিলাম যাতে ভয় না পাস। তুই আমার বুকে মাথা লুকিয়ে ছিলি, ভয়ে কাপছিলি, আমি তোকে কৌতুক শুনিয়ে হাসানোর চেষ্টা করছিলাম। বাবা যখন মারা গেলো তুই তখন অনেক ছোট ছিলি। আমরা ভাই বোনেরা যেখানে কাঁদছিলাম তুই সেখানে আমার গলা জরিয়ে ধরে বলেছিলি, 'ভাইয়া লজেন খাবো'! আমি কিন্তু তোকে তখন লজেন্স কিনে দিয়েছিলাম। তুই জানিস না ভাই গরমের রাতে হঠাৎ করে জেগে উঠে যখন দেখতাম তুই ঘেমে গেছিস, তখন পাখাটা দিয়ে পুরো রাত বাতাস করতাম তোকে। তোর কপালের ঘাম আস্তে আস্তে শুকিয়ে যেতে দেখতাম। খুব ভালো লাগতো জানিস!! বড় বোন গুলা আর তোর কথা চিন্তা করেই পড়াশুনা আর করিনি। বাবা মারা যাওয়ায় আমার কিশোর মনে এসে পরে পরিবার চালানোর টেনশনের চাপ। কতো দোকানে কাজ নিয়েছি। প্রথম প্রথম গালি, মার সব খেয়েছি। পাগলের মত কাজে ডুবার চেষ্টা করে গেছি। মালিকের নিগ্রহ, মানুষের ঘৃনা, কাজের বোঝা থাকা সত্ত্বেও কিন্তু প্রতি রাতে তোর জন্য লজেন্স আনতে ভুলিনি মনে আছে তোর?? তারপর আস্তে আস্তে বড় হলি। অন্যান্য ছেলেদের সাথে নিজের তুলনা করা শিখলি। তুই বুঝে গেলি আমি তোকে অনেক কিছুই দিতে পারিনি। তোর বন্ধুদের এটা ছিলো, ওটা ছিলো, এটা খেতো, ওটা পরতো কিন্তু তুই কিছুই পাস নি। তোর গরিব ভাই তোকে কিছুই দিতে পারেনি। তোর ভেতর চাপা অভিমান আসতে শুরু করলো। আমার কাছ থেকে দুরে থাকার চেষ্টা করতি। আমি বুঝতাম সব। তুই কি বুঝতি না আমারও খুব কষ্ট হতো!! এক এক করে বড় বোন গুলাকে অনেক কষ্টে বিয়ে দিলাম। তোর বড় হতে আরো অনেক দেরি। তাই নিজের কথা ভাবিনি। সংসার একটু হালকা হলে তোকে সাধ্যমত সব কিছু দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তবুও তোর সব চাওয়া পুরন করতে পারতাম না। এভাবেই বড় হলি। তোর মনে অজানা জিদ ছিলো তাই পড়াশোনায় খুব ভালো করলি। চাকুরীও পেয়ে গেলী। আমি আর মা কিছু বুঝে উঠার আগেই পছন্দের মেয়েকে ঘরে তুলে আনলি। তুই হয়তো ভাবছিলি ওই মেয়েকে বিয়ে করে আনায় আমরা রাগ করেছিলাম.…আসলে তা না! অনেক খুশি হয়েছিলাম যে আমার ছোট্ট ভাইটা অনেক বড় হয়ে গেছে। নিজের পছন্দ অপছন্দ কে গুরুত্ব দেয়া শিখেছে। অন্যের উপর আর নির্ভর না করে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে শিখেছে।! আজ তুই প্রথম আমার চোখে চোখ রেখে কথা বললি! তোর চোখের ভেতর শ্রদ্ধা, মায়া সেই ছোটবেলায় দেখেছিলাম তারপর তোর চোখে তাকালে আমি একটা নিরব অভিমান দেখতে পেতাম। আজ সেই চোখে আমি স্পষ্ট ঘৃণা দেখলাম। তোর মনে যে অভিমান, ক্ষোভের পাহাড় জমে ছিলো তা আজকে প্রকাশ করে দিলি। আমি তোকে কি দিতে পেরেছি আর কি পারিনি সব বলে দিলি। আর এটাও বলে দিলি যে আমার সাথে তোরা আর মানিয়ে নিতে পারছিস না। আমাকে আর তোরা সহ্য করতে পারছিস না। কারন আমি মাঝ বয়সী অবিবাহিত আনকালচারাল, ব্যাকডেটেড। অনেক কথাই শুনালি ভাই! আমার বুড়া মা কে তুই নিয়ে গেলি। মা তো অনেক কান্নাকাটি করলো আমাকে ছেড়ে যাবেনা বলে। কিন্তু বিশ্বাস কর তোর কথা ভেবে মা কে জোর করে পাঠালাম তোদের সাথে। কিন্তু ভাই মা অনেক বুড়া মানুষ। তোর সংসারের সব কাজ করে দিতে পারবে না। একটু খেয়াল রাখিস। রাখবি তো! আর মাকে বলে দিস আমার একা থাকতে কষ্ট হবেনা। একাই রান্না করে খেতে পারবো। বাবা মারা যাবার পর এই বড় সংসারটা নিজের একার কাধে নিয়েছিলাম। বড় বোন গুলা একটা একটা করে চলে গেলো। তুই ও আজ গেলি। আমার আত্মার শেষ সম্বল মা কেও নিয়ে গেলি! আজ আমি একা বড্ড একা হয়ে গেলাম রে!! শেষ বাবা মারা যাওয়ায় কেঁদেছিলাম তারপর পরিবারের টেনশন, কাজের চাপে আমার মনটা পাথর হয়ে গেছে। তাই কান্না আর আসে না। কিন্তু বুকে কষ্টটা চেপে বসে থেকে পীড়া দেয় খুব। ভাই আমাকে মাফ করে দিস, তোর কপাল খারাপ ছিলো যে এমন একটা অপদার্থ ভাই পেয়েছিস। বিশ্বাস কর, তুই কিছু চাইলে না দিতে পারলে তোর চাইতে আমারই বেশি কষ্ট হতো! এই বুড়ো ভাইটাকে মাফ করে দিস। দিবি না? দিস ভাই! আর কিছু চাইনা তোর কাছে। . . . . এখন লোকটার কেউ নেই। একা পরে থাকেন। সংসারের সেই চাপ নেই। খোজ নেবার মানুষ ও নেই। মাঝ বয়সি, অবিবাহিত সেই মানুষটি একা একা পরে থাকেন শুধু তার বেদনা বিধুর অতীত স্মৃতি নিয়ে।

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment