Friday, August 17, 2012

ও হেনরীর ছোট গল্প – বিশ বছর পরে

Leave a Comment
পেশাগত গাম্ভীর্য নিয়ে পুলিশ
অফিসারটি তাঁর টহল
পথে পা ফেলে এগিয়ে চলেছে।
মানুষকে দেখানোর জন্য নয়, এই
গাম্ভীর্যটা তাঁর অভ্যেস,
কেননা আশেপাশে দেখবার মতো তেমন কেউ ছিল না। সময় বেশি হয় নি, বড় জোর রাত
দশটা, কিন্তু তীব্র আকস্মিক ঝড়ো হাওয়া আর
হালকা বৃষ্টির জন্য রাস্তাটা জনশূণ্য
হয়ে পড়েছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক একটা দরজা পরখ
করে দেখছিল সে, কখনো কখনো তাঁর হাতের
লাঠিটি দুর্বোধ্য ও বেয়াড়াভাবে আন্দোলিত
হচ্ছিল, ইতস্ততভাবে ঘাড় ফিরিয়ে সতর্ক
দৃষ্টিতে দেখছলি প্রশান্ত রাজপথকে,
তিনি অফিসার, তাঁর স্থিরপ্রতিজ্ঞ মূর্তি ও মৃদু হামবড়াভাব সব মিলিয়ে শান্তির
দেবদূতের সুন্দর একটা প্রতিচ্ছবি যেন
ফুটে উঠেছে। মাঝে মাঝে দুই একটা চুরুট
স্টোর বা সারা রাত্রী খোলা খাবারের
দোকানের আলো চোখে পড়ে, কিন্তু অনেক আগেই
বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ ব্যবসা- প্রতিষ্ঠানের দড়জা। নির্দিষ্ট এক জায়গার মাঝামাঝি এসে হঠাৎ
হাঁটার গতি কমিয়ে আনল পুলিশ অফিসারটি।
অন্ধকার হয়ে আসা এক হার্ডওয়্যার স্টোরের
দরজায় হেলান
দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক, তাঁর ঠোঁটের
ফাঁকে গুঁজে রাখা চুরুটটায় এখনো আগুন ধরানো হয় নি। পুলিশ অফিসারটি তাঁর দিকে হেঁটে আসতেই
লোকটি দ্রুত কথা বলে উঠল, “ঠিক
আছে অফিসার”। লোকটি তাঁকে পুনঃআশ্বাস
দিয়ে বলল, “আমি ঠিক আমার এক বন্ধুর জন্য
অপেক্ষা করছি। এখানে আজকের এই
দেখা করার সময়টা ঠিক হয়েছিল বিশ বছর আগে। কথাটি আপনার কাছে কিছুটা অদ্ভুত
শুনাচ্ছে, তাই না? ঠিক আছে,
আপনি শুনতে চাইলে আমি ব্যাপারটি খোলাসা করে বলতে পারি।
অনেক কাল আগে ঠিক এই স্টোরটার জায়গায়
একটা রেস্তোরাঁ ছিল—‘বিগ জো’ ব্র্যাডির
রেস্তোরাঁ।” “পাঁচ বছর আগেও ছিল”, পুলিশ
অফিসারটি বলল, “এর পর এটি উঠে যায়”। দরজায় হেলান দেওয়া লোকটি দেয়াশেলাই
ঠুকে তাঁর চুরুটটা ধরাল। দেয়াশেলাইয়ের
আলোয় দেখা গেল এক ফ্যাকাশে মুখ,
লম্বা চওড়া চিবুক, উৎসুক এক জোড়া চোখ আর
ডান চোখের ভুরুর
কাছাকাছি একটা সাদাটে ছোট কাটা দাগ। তাঁর স্কার্ফের
পিনে অদ্ভুতভাবে বসানো একটা বড় আকারের
হিরে। “বিশ বছর আগে আজকের এই রাতে”,
লোকটি বলে চলল, “এখানে ‘বিগ জো’
ব্র্যাডির রেস্তোরাঁয় এই পৃথিবীতে আমার
সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু, সবচেয়ে কাছের মানুষ
জিমি ওয়েলসের সাথে রাতের খাবার
খেয়েছিলাম। ও আর আমি এই নিউইয়র্ক শহরে আপন দুই ভাইয়ের মতো এক সাথে বড়
হয়েছি। আমার বয়স তখন আঠার আর জিমির
বিশ। পরের দিন সকালে ভাগ্য গড়তে আমার
পশ্চিমের দিকে বেরিয়ে পরার কথা ছিল।
জিমিকে কিছুতেই আপনি কখনো নিউইয়র্কের
বাইরে নিয়ে যেতে পারবেন না; ওর ধারনা পৃথিবীতে এই একমাত্র জায়গা।
যা বলছিলাম, সেদিন আমরা দুই জন একমত
হয়েছিলাম বিশ বছর পরে আমরা আবার
এখানে দেখা করব ঠিক এই তারিখ ও এই
সময়ে, আমাদের অবস্থা যাই হোক না কেন, আর
যত দূরেই আমরা থাকি না কেন। ধরে নিয়েছিলাম, এই বিশ
বছরে আমরা আমাদের
লক্ষ্যে পৌছে যেতে পারব আর আমাদের ভাগ্যও
নির্ধারিত হয়ে যাবে, যেভাবে হওয়ার
কথা ছিল”। “খুব আকর্ষণীয় ব্যাপার মনে হচ্ছে”, পুলিশ
অফিসার বলল। “দু-বারের দেখা হবার মাঝের
সময়টা অনেক লম্বা বলে মনে হচ্ছে আমার
কাছে। আপনি চলে যাওয়ার পর বন্ধুর
কোনো খোঁজ-খবর আর পান নি?”
“জ্বি, হ্যা, বেশ কিছুদিন আমরা একে অপরের সাথে চিঠিপত্র আদান প্রদান করেছি”,
লোকটি বলল। “কিন্তু দুই এক বছর
পরে আমাদের একে অপরের সাথে যোগাযোগ
বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আপনি হয়ত জানেন,
পশ্চিম অনেক বড় জায়গা, আর
সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য আমাকেও অনেক ঠেলাঠেলি করতে হয়েছে। কিন্তু
আমি জিমিকে চিনি, ও
যদি বেঁচে থাকে অবশ্যই আমার
সাথে দেখা করতে আসবে এখানে, কারন ও ছিল
পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে খাঁটি মানুষ আর
সবচেয়ে বিশ্বস্ত পুরনো বন্ধু। ও ভুলে যাবে না কখনো। আমি হাজার হাজার
মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আজ রাতে এই দরজার
সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, আমার পুরনো বন্ধু
যদি আসে তবেই সেটা সার্থক হবে”। ঢাকনার ওপর ছোট ছোট হিরের
টুকরো বসানো একটি সুদৃশ্য ঘড়ি পকেট
থেকে বের করল অপেক্ষারত লোকটি। “দশটা বাজতে তিন মিনিট বাকি”,
ঘড়ি দেখে বলল লোকটি। “ঠিক দশটায়
আমরা সেদিন রেস্তোরাঁর দরজা থেকে বিদায়
নিয়েছিলাম”।
“পশ্চিমে যেয়ে ভালোই লাভবান হয়েছেন,
তাই না?”, পুলিশ অফিসার জানতে চাইলো। “আপনি ঠিক বলেছেন! আশা করছি, জিমি এর
অর্ধেক হলেও জুটিয়েছে। ও খুব ভালো লোক,
ধীরে ধীরে ক্রমাগত কাজ
করে নিরবে এগিয়ে যাওয়া ওর পছন্দ।
প্রতিষ্ঠা পেতে আমাকে পাল্লা দিতে হয়েছে কিছু
তীক্ষ্ণতর বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সাথে। নিউইয়র্ক শহর একজন মানুষকে এক
ঘেয়ে জীবনরীতিতে অভ্যস্ত করে তোলে, আর
পশ্চিম তাঁর জীবনকে করে ক্ষুরধার”। পুলিশ অফিসার তাঁর
লাঠিটি মোচড়াতে মোচড়াতে দুই এক
পা সামনে এগিয়ে বলল,
“আমাকে কাজে যেতে হচ্ছে। আশা করছি,
আপনার বন্ধু সময় মতো চলে আসবে। তাঁর
সাথে দেখা হবার পরেই কি চলে যাচ্ছেন?” “না না!”, “আমি ওকে কম করে হলেও
আধা ঘন্টা সময় দেব।
যদি জিমি পৃথিবীতে বেঁচেবর্তে থাকে,
তবে ও ঠিক সময়েই এখানে হাজির হবে।
ভালো থাকবেন, অফিসার”। “শুভ রাত্রী, স্যার”, লোকটিকে বিদায়
জানিয়ে পুলিশ অফিসার তাঁর টহল পথের
দরজাগুলো পরীক্ষা করতে করতে এগিয়ে যায়। ততক্ষনে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে আর হঠাৎ
হঠাৎ আসা বাতাস একটানা সজোরে বইতে শুরু
করেছে। যে কয়েকজন পথচারী তখনো রাস্তায়
ছিল, কোটের কলার উচু করে হাত
পকেটে ঢুকিয়ে নিরবে দ্রুত
হেঁটে চলে যাচ্ছিল। আর হার্ডওয়্যার স্টোরের দরজায় দাঁড়িয়ে যে লোকটি হাজার
হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে তাঁর
তরুন বয়সের ফেলে আসা বন্ধুটির
সাথে কথা দেয়া অনিশ্চিত, প্রায় উদ্ভট
সাক্ষাৎকার বজায় রাখতে, চুরুটের
ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অপেক্ষা করে চলল সে। প্রায় বিশ মিনিট অপেক্ষার পর, এক লম্বামত
লোক লম্বা ওভারকোট গায়ে চাপিয়ে কান
পর্যন্ত কলার টেনে দিয়ে রাস্তার অপর পার
থেকে দ্রুত তাঁর দিকে এগিয়ে এল। “তুমি বব?”, অনেকটা সন্দেহ
নিয়ে জানতে চাইলো লোকটি।
“তুমি জিমি ওয়েলস?”, দরজায়
দাঁড়ানো লোকটি চিৎকার করে কেঁদে উঠল। “আহা শান্তি!” নবাগত
বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল, উভয়েই
ততক্ষনে পরস্পরের হাত মুঠোয় ধরে রেখেছে।
“আমার বিশ্বাস ছিল, তুমিই বব।
আমি নিশ্চিত ছিলাম,
যদি তুমি এখনো বেঁচে থাকো আমি তোমাকে এখানেই খুঁজে পাবো। ভালো, ভালো, খুব ভালো— বিশ
বছর অনেক লম্বা সময়।
পুরনো রেস্তোরাঁটা উঠে গেছে বব;
যদি ওটা থাকত, তবে এখানে আরেকবার
একসাথে রাতের খাবারটা সারা যেত।
পশ্চিমে তোমার কেমন কাটল, আমার বুড়ো বন্ধু?”
“খাসা! সব পেয়েছি আমি যা চেয়েছিলাম।
তুমি অনেক বদলে গেছ, জিমি। আমি কখনোই
ভাবি নি তুমি আরও দুই তিন
ইঞ্চি লম্বা হয়ে যাবে”।
“ওহ! বছর বিশের পরে আরও কিছুটা বেড়েছি”।
“নিউইয়র্কে ভালোই চলছে, জিমি?”
“মুটামুটি। শহরের
সরকারী একটা দপ্তরে কাজ করি। চল, বব;
আমার পরিচিত একটা যায়গায় গিয়ে অনেক
সময় ধরে পুরনো দিনের সব গল্প করা যাবে”। হাত ধরাধরি করে রাস্তা ধরে এগোল দুই জন।
পশ্চিম থেকে আসা লোকটি, সাফল্য
পেয়ে আত্নপ্রচারে মেতে উঠেছিল যে,
সে তাঁর পেশাজীবনের ইতিহাস বলা শুরু করল
একে একে।
ওভারকোটে ঢেকে যাওয়া লোকটি আগ্রহসহকারে খুব মনোযোগের সাথে শুনে যাচ্ছিল। গলির এক
কোনায় ছিল একটা ঔষুধের দোকান, যেখানটায়
জ্বলছিল উজ্বল বৈদ্যুতিক বাতিগুলো। এই
আলোতে এসে দুই জন একসাথে একে অপরের
দিকে মুখ ফিরে তাকালো। পশ্চিম
থেকে আসা লোকটি হঠাৎ থেমে গিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। “তুমি জিমি ওয়েলস নও”, দাঁতে দাঁত
কামড়ে বলল লোকটা। “বিশ বছর অনেক দীর্ঘ
সময়, কিন্তু এত দীর্ঘ সময় নয় যেখানে এক
জনের রোমান ধাঁচের নাক বদলে বোঁচা নাক
হয়ে যায়”। “সময় কখনো কখনো একজন
ভালো মানুষকে খারাপ মানুষে বদলে দেয়”,
লম্বা লোকটি বলে চলল, “আপনি দশ মিনিট
ধরে গ্রেপ্তার হয়ে আছেন, ‘সরল’ বব।
শিকাগো পুলিশ ধারণা করেছিল
আপনি এদিকটায় আসবেন, তাই ওরা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জানিয়েছিল, আপনার সাথে আলাপ
করতে চায়। শান্তভাবেই যাবেন, যাবেন কি?
এটাই শুভবুদ্ধির পরিচয় হবে। এখন, পুলিশ
স্টেশনে রওনা দেবার আগে আপনাকে এই
চিঠিটা দিতে বলা হয়েছে আমাকে।
আপনি চিঠিটি এই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে পারেন। এটি টহল
পুলিশ অফিসার ওয়েলস পাঠিয়েছে”।
পশ্চিম
থেকে আসা লোকটি তাঁকে দেওয়া কাগজের
টুকরোটির ভাঁজ খুলল। যখন চিঠিটি পড়তে শুরু
করল লোকটি, তখনও তাঁর হাতটি স্থির ছিল, কিন্তু চিঠিটি পড়ে শেষ করার পরই তাঁর হাত
মৃদুভাবে কাঁপতে লাগল। চিঠিটায় অল্প কিছু
কথা লেখা ছিল। “বব,
আমি ঠিক সময়েই দেখা করার স্থানে হাজির
হয়েছিলাম। চুরুট ধরানোর জন্য যখন
দেয়াশেলাই জ্বালালে, তখনই আমি দেখলাম
তোমাকে, এই মুখের এক জনকে শিকাগো পুলিশ
খুঁজছিল। যাই হোক, কাজটা নিজের হাতে করতে পারলাম না, তাই
আমি ফিরে এসে সাদা পোষাকের
একজনকে পাঠালাম দায়িত্বটা সম্পন্ন করতে।
জিমি”

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment