Monday, August 6, 2012

একজন হোমিওপ্যাথিক বিজ্ঞানী

Leave a Comment
১৭৫৫ সাল এপ্রিলের মধ্যরাতে জার্মানের
মিসেন শহরে দরিদ্র পরিবারে জন্মায় এক
শিশু। তখনও কেউ কল্পনা করতে পারেনি এই
শিশুই একদিন হয়ে উঠবে আধুনিক
চিকিৎসাবিজ্ঞান জগতে এক নতুন ধারার
জন্মদাতা। শিশুটির নাম দেওয়া হয় ক্রিশ্চিয়ান ফ্রিডরিখ সামুয়েল হানিমান্ ।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থার
জন্মদাতা বলা হয় হানেমানকে।
হানিমান্ ছিলেন চার ভাইবোনের
মধ্যে তৃতীয়। পিতামাতার প্রথম পুত্র সন্তান।
বাবা গডফ্রিড ছিলেন চিত্রকর। তাই বাবার আশা ছিল হানেমান্ বড় হয়ে উঠলে তারই
সাথে ছবি আঁকার কাজ করবে।
বাবাকে সহযোগিতা করে পরিবারের দরিদ্র
অবস্থার উন্নতি করবে।
কিন্তু হানিমান্ -এর আগ্রহ পড়াশোনায়।
সে স্কুলে যেতে চায়। বারো বছর বয়সে হানিমান্ ভর্তি হলেন স্থানীয় টাউন
স্কুলে। অল্পদিনের মধ্যেই তার অসাধারণ
মেধার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ তার স্কুলের
শিক্ষকরা।
টাউন স্কুলে শিক্ষা শেষ করে হানিমান
ভর্তি হলেন প্রিন্সেস স্কুলে। এদিকে সংসারে অভাব ক্রমশ বেড়েই চলছে।
বাবা গডফ্রিডের পক্ষে সংসার চালানো সম্ভব
হচ্ছিল না। নিরুপায় হয়ে ছেলে হানিমানকেও
কাজে লাগিয়ে দিতে হলো।
একটি মুদি দোকানে হানিমান্ কাজ শুরু করলেন।
স্কুল কর্তৃপক্ষ এই ঘটনায় খুবই হতাশ হলেন। মেধাবী হানিমানের পড়া বন্ধ হোক
এটা তারা চাচ্ছিলেন না। তাই তার
পড়াশোনার সব খরচ স্কুল কর্তৃপক্ষ মওকুফ
করে দিল। শুরু হয় আবার পড়াশোনা।
যথাসময়ে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় অসাধারণ
কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন হানিমান্ । পিতার অমতেই লিপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তি হবার জন্য বেরিয়ে পড়েন।
হানিমানের ইচ্ছে ছিল চিকিৎসাশাস্ত্রে
অধ্যয়ন করবেন। তখন কোন ডাক্তারের
অধীনে থেকে কাজ শিখতে হত। লিপজিকে কোন
ভালো হাসপাতাল ছিল না। তিনি ভিয়েনাতে ডাক্তার ফন কোয়ারিনের
কাছে কাজ করার সুযোগ পেলেন। তখন তার বয়স
মাত্র বাইশ বছর।এরই মধ্যে তিনি গ্রিক,
ল্যাটিন ইংরেজি, ইতালিয়ান, হিব্রু, আরবি,
স্প্যানিশ এবং জার্মান ভাষায় যথেষ্ট
পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এবার ভাষাতত্ত্ব ছেড়ে শুরু হলো চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন।
হাতে কিছু অর্থ সঞ্চয় হতেই তিনি ভর্তি হলেন
আরলাংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই
২৪ বছর বয়সে ‘ডক্টর অব মেডিসিন’
উপাধি অর্জন করেন। ডাক্তারি পাশ করে এক
বছর প্র্যাকটিস করার পর তিনি জার্মানির এক হাসপাতালে চাকরি পেলেন।
কিন্তু হানিমানের আগ্রহ পৃথিবীর বিভিন্ন
বিষয়ে। চিকিৎসা নিয়েই তিনি পড়ে নেই। হুট
করেই তিনি বিভিন্ন বই অনুবাদ করা শুরু
করলেন। এক
পর্যায়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি অনুবাদক হয়ে উঠলেন।
একবার এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
ডাক্তার কালেনের একটি বই অ্যালোপ্যাথিক
মেটিরিয়া মেডিকা বইটি ইংরেজি থেকে জার্মান
ভাষায় অনুবাদ শুরু করেন।
সেখানে একটি অধ্যায়ে দেখতে পেলেন ম্যালেরিয়া জ্বরের ঔষধ কুইনাইন
যদি কোনো সুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ
করা যায় তবে অল্পদিনের মধ্যেই তার
শরীরে ম্যালেরিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাবে।
কালেনের বই থেকে পাওয়া এই
বক্তব্যটি হানিমানের চিন্তার জগতে নাড়া দিল। তিনি পরীক্ষা শুরু করলেন।
প্রতিদিন ৪ ড্রাম করে দুবার সিঙ্কোনার রস
খেতে থাকলেন। তিন চারদিন পর লক্ষ্য করলেন
সত্যিই সত্যিই তিনি ম্যালিরিয়াতে আক্রান্ত
হলেন। এরপর পরিবারের প্রত্যেকের উপর এই
পরীক্ষা করলেন। প্রতিবারই একই ফলাফল পেলেন। এরপর থেকে মনে প্রশ্ন জাগলো।
এতদিন চিকিৎসকদের ধারণা ছিল মানুষের
দেহে অসুস্থ অবস্থায় যে সব লক্ষণ প্রকাশ পায়
তার বিপরীত ক্রিয়াশক্তি সম্পন্ন ঔষধেই রোগ
আরোগ্য হয়। এই প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে শুরু হল
তার গবেষণা। গোটার ডিউক মানসিক রোগের চিকিৎসালয়
খোলার জন্য তার
বাগানবাড়িটি হানিমানকে ছেড়ে দিলেন।
১৭৯৩ সালে হানিমান্ এখানে হাসপাতাল
গড়ে তুললেন। এবং একাধিক মানসিক
রোগীকে সুস্থ করে তোলেন। দীর্ঘ ছয় বছরের অক্লান্ত গবেষণার পর তিনি সিদ্ধান্তে এলেন
যথার্থই সদৃশকে সদৃশ আরোগ্য করে। তার এই
আবিষ্কার ১৭৯৬ সালে সে যুগের
একটি বিখ্যাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
প্রবন্ধটির নাম দেওয়া হলো (An essay on a
new Principle for Ascertaining the curative Powers of Drugs and some
Examination of the previous principle.)
এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আধুনিক হোমিওপ্যাথিক
চিকিৎসার ভিত্তি পত্তন করলেন হানিমান-
সেই কারণে ১৭৯৬ সালকে বলা হয়
হোমিওপ্যাথির জন্মবর্ষ। হোমিওপ্যাথি শব্দটির
উৎপত্তি হয়েছে গ্রিকশব্দ `হোমোস`
এবং `প্যাথোস` থেকে।হানিমানের এই
যুগান্তকারী প্রবন্ধ প্রকাশের
সাথে সাথে চিকিৎসা জগতে প্রায় সবাই এই
মতের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে গেল। তার বিরুদ্ধে পত্র পত্রিকায় তীব্র সমালোচনামূলক
লেখা শুরু হলো। তাকে ‘হাতুড়ে চিকিৎসক’
উপাধি দেওয়া হলো। নিজের আবিষ্কৃত সত্যের
প্রতি তার এতখানি অবিচল আস্থা ছিল,
কোনো সমালোচনাতেই তিনি সামান্যতম
বিচলিত হলেন না।তার পড়াশোনা আরও বাড়তে থাকে। গবেষণাও চলতে থাকে।
পরে ১৮০৫ সালে ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশ
করলেন ২৭টি ঔষধের বিবরণ সংক্রান্ত বই। এই
বইটি প্রথম হোমিওপ্যাথিক
মেটিরিয়া মেডিকা বা ভেষজ লক্ষণ সংগ্রহ।
এরপর থেকেই তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা আরম্ভ করেন।লিপজিগ
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক
হানিমানের চিন্তাধারায় আকৃষ্ট
হয়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
করতে চাইলেন। কিন্তু শিক্ষকদের একাংশ
এতে বাধা দিল। কিন্তু তাদের বাধা সত্ত্বেও হানিমান্ সুযোগ পেলেন।
এবং একটি বক্তৃতা দিলেন। তার
বক্তৃতা শুনে দলে দলে শিক্ষার্থীরা তার
মতের সঙ্গে একাত্ম হলো। কৌতূহলীও
হয়ে উঠলো। এ সময় ফরাসি সম্রাট
নেপোলিয়ানের সেনাবাহিনী রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন
করছিল। তাদের মধ্যে বহু সংখ্যক সৈন্য
টাইফাস রোগে আক্রান্ত। কোনো চিকিৎসাই
কাজে দিচ্ছে না। সেই সময়
ডাকা হলো হানিমানকে। তিনি বিরাট সংখ্যক
সৈন্যকে অল্পদিনের মধ্যেই সুস্থ করে তোলেন। এতে তার নাম ছড়িয়ে যেতে শুরু করলো।
তারপরও নিজের দেশে সংগ্রাম করেই কাজ
করতে হতো হানিমানকে। কিন্তু তার জীবনের
মোড় ঘুরে শেষ বয়সে। ১৮৩৪ সালে এক
সুন্দরী নারী মাদাম
মেলানি চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য আসেন হানিমানের কাছে।
মেলানি ছিলেন ফ্রান্সের প্রাক্তন
রাষ্ট্রপতির পালিত কন্যা। হানিমানের
সাথে সাক্ষাতের সময় তার বয়স ছিল ৩৫।
মেলানি ছিলেন শিল্পী-কবি। বয়েসের বিরাট
ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে গড়ে উঠলো প্রেমের সম্পর্ক। বিয়েও
হলো। মেলানি ফ্রান্স নিয়ে গেলেন
হানিমানকে। সেখানেই প্রথম
সরকারিভাবে হানিম্যান ডাক্তারি পেশা শুরু
করেন। জীবনের শেষ সময়ে এসে হানেমান্
পেলেন সব সংগ্রামের পুরস্কার, খ্যাতি, অর্থ। ৮৮ বছর বয়সে ১৮৪৩ সালে পৃথিবীর
মায়া ত্যাগ করে চিরবিদায় নেন
হোমিওপ্যাথির জনক হানিমান্।

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment