Wednesday, May 1, 2013

রবিন,এক টোকাই এর নাম

Leave a Comment


রবিন - ওই শোন আইজকা আমি টিলার পাশের যায়গাটা তে খুটমু আর তুই মড়া খালের পাশ দিয়া টুকাইবি।

রকি - ওই হানে তো বেশি আঙচা পাওয়া যায় না…

- কাগচ তো পাওয়া যাইবো। যা যা…বেলা হইয়া যাইতেছে।

বলে দুইজন দুই দিকে চলে গেলো। এরা আসলে টোকাই। থাকে শহরের অদুরে এক বস্তিতে। খুব সকালে বস্তা হাতে বের হয় কাগজ, পলিথিন খুটতে। দিন শেষে এই পলিথিন, কাগজ বিক্রি করবে পান-মোল্লার কাছে।

রবিন টিলার পাশে একটা লাঠি দিয়ে আবর্জনা সরিয়ে সরিয়ে কাগজ খুজছে। পেলে বস্তায় ভরছে। একটু পর রকি কে এইদিকে আসতে দেখলো।

- ওই শালার পুত…তোরে না কইছি মড়া খালের ওই দিকে যাইতে!!

- খালের ওই দিকে সাপ বারায় খালি…ডর লাগে রে…

- কিসের ডর? আসার টাইমে তোর মা তোরে ফুক দেয় নি?

- না…আম্মায় ওই সব পারে না।

- কি কস? আমার আম্মায় সূরা জানে…প্রত্যেক দিন আমারে সূরা পইরা বুকে ফু দিয়া দেয়.…

- কাইল থেইকা তোর মার কাছ থিকি ফুক দিয়া নিমু।

- আইচ্ছা নিস.…আর আমার এই হান থেইকা সইরা যা…ওই দিকে খুট।

- আইচ্ছা!!

দুইজন পাশাপাশি কাগজ কুড়াতে থাকে। একটু পর রবিন দেখলো রকি ঢিল হাতে নিয়ে কোথায় জানি ছুড়ে মারলো!!

- ওই হালা!! ঢিল লইয়া কি করস?

- একখান কাইয়ারে মাইরলাম দোস্ত।

- ও…আমার হাতে নিশ দেখবি?

- কেমনে?

- এই দেখ…

বলে রবিন টিলার পাশে এলো। মাটি দিয়ে দেয়ালে একটা গোল বৃত্ত দিলো। এবার কিছু পাথর কুড়িয়ে নিলো। কিছুদুরে গিয়ে একটা একটা করে পাথর ওই বৃত্তের দিকে ছুড়ে মারতে লাগলো। রকি অবাক হয়ে দেখলো প্রতিটা পাথর গিয়ে ওই বৃত্তের ভেতরেই লাগছে।

রকি - আরে বাসস…তোর তো জব্বর নিশ…

রবিন - হ…ছূডুবেলা থেইকা পাত্থর মাইরা নিশ নিশ খেলতাম…সেই থেইকা এমুন নিশ।

- আমারে শিখাইবি?

- হুর হালা…এইডা কি শিখানোর জিনিস.…এমনি এমনি হইয়া গেছে আমার।

- ও…হের লাইগা!!

- বেশি পকপক মারাইস না। যা যা কাম কর।

দুজন মিলে আবার কাগজ জোগাড় করা শুরু করলো। আজ ওরা অনেক কাগজ পেয়েছে। মন বেজায় খুশি ওদের।

খুশি মনে চললো পান মোল্লার কাছে। কাগজ গুলা বিক্রি করবে। লোকটা সবসময় পান চিবায় আর মুখে লম্বা দাড়ি আর মাথায় টুপি থাকে বলে ওরা নাম দিয়েছে পান মোল্লা।

" নানা! আইজকা ম্যালা খুটছি। নেন নেন মাইপা নেন। " বলে বস্তা দুইটা পাশে রাখলো।

পান মোল্লা মাপ নেয়ার পর রবিনের হাতে দশ টাকার তিনটা নোট ধরিয়ে দিলেন।

রবিন- কি দিলেন নানাজান?? কাইলকাই তো লাল নোট চাইরখান দিলেন। আইজকা তিনখান কেন?

পানমল্লা- কাগুজের দাম আর নাই রে…দাম কইমা গেছে। যা দিছি বহুৎ বেশি দিছি।

- নানাজান! এইডা কি কন? কাইলকাই তো চাইরখান দিলেন!!!

- আইজকা দাম নাই। যা ভাগ…মুখে মুখে তর্ক করা শিখছস…ঘাড় ধইরা আছার মারুম.…

রবিনের চোখে ফেটে জল আসতে লাগে…ভেতরে ভেতরে রেগে যায় প্রচন্ড। ওর এমনিতেই রাগ বেশি। তবে আর কিছু বলল না। রকির কাগজ মাপা শেষে দুজন একসাথে হাটা দিলো বাড়ির দিকে।

যেতে যেতে নোট গুলা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকলো। নোট গুলার এক যায়গায় কেমন জানি চকচক করে আর সাদা এক যায়গায় কাত করে দেখলে কেমন জানি ডোরাকাটা দাগ দেখা যায়।

এই দুইটা জিনিসই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলো রবিন।

শহরের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সামনে একটা দোকান চোখে পরে। দোকানটার সামনে কিছু বড়লোকের ছেলে মেয়ে দাড়ানো। একটা বাক্স থেকে লম্বা তেকোনা একটা জিনিস বের করে নেয় ওরা আর চেটে চেটে খায়। রবিন জানে ওইটাকে বরফ বলে। আরেকটা কাঠখোট্টা নাম আছে ওটার কিন্তু রবিন উচ্চারন করতে পারেনা। রবিনের ও খুব ইচ্ছা করে ওই জিনিস খাওয়ার। কিন্তু সে শুনেছে অনেক দাম ওগুলার।

অনেক হেটে শেষে বস্তিতে পৌছায়। বস্তায় মোড়ানো একটা ঘরে ঢুকে। দেখে ওর মা কাজ শেষে থালাতে করে খাবার এনেছে। দুইজন মিলে খায়। খেতে খেতে কথা হয়…

- মা! ওই তেকোনা বরফের আরেকখান নাম কিজানি তুমি কইছিলা?

- ও, ওইডা তো আইচ্ִরিম! আমাগো ছোট সাহেব খায়।

- আমার খাইতে খুব ইচ্ছা করে।

- বাপজান!! ওইডার দাম মেলা! দেহি এইবার বেতুন পাইলে তোরে একটা কিনা খাওযামু।

- হাছা কইলা তো মা??

- হাছাই তো!!

- রকিরে সক্কাল বেলা ফুক দিয়া দিয়ো তো। ওর মায় নাকি পারেনা।

- ও, ওরে আইস্ִতে কইস, দিমুনে।

এভাবে খাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পরে। সকাল বেলা ওর মা ওকে ডেকে দেয়। রকি আসলে দুইজনকে একসাথে সুরা পরে ফু দিয়ে দেয়।

আবার দুজন চলে যায় কাগজ কুড়াতে। রকি গেছে মড়া খালের দিকে।

টিলার পাশ দিয়ে যেতে হঠাৎ করে রবিনের চোখে একটা কাগজ ধরা পরলো। সুন্দর চারকোনা কাগজ। একদম টাকার নোটের মত। সে কাগজটা হাতে নিলো। পান-মোল্লা ওকে যেসব নোট দেয় তার থেকে এটা বড়।

কাগজের একযায়্গায় চকচক করছে। সে কাগজটা একটু কাত করলো এবং ডোরাকাটা দাগ দেখতে পেলো। এবার সে নিশ্চিত হয়ে গেলো যে কাগজটা হলো টাকার নোট। যেহেতু নোট টা একটু বড় সে ভাবলো নিশ্চই এটা অনেক টাকা হবে।

নোট টা প্যান্টের চিপায় গুজে নিলো। বস্তা টিলার কোনায় রেখে শহরের দিকে হাটা দিলো। রকি জানতেও পারলো না।

আইসক্রিমের দোকানের সামনে আসলো। এতো সকালে লোকজন তেমন একটা নেই।

দোকানদারকে বললো,

- দেখেনতো এই ট্যাকা দিয়া কি দুই খান বরফ হইবো? এই যে এইগুলান!! হইব?

- দেখি টাকাটা!

দোকানদার টাকাটা দেখে অবাক হয়ে গেলো। একহাজার টাকার নোট। রবিনের দিকে তাকালো। রবিনের গায়ে ছেঁড়া জামা আর প্যান্ট। সে রবিনরে বললো,

- ওই চোরের বাচ্চা চোর! কার টাকা চুরি করছোস বল!!

- আমি চুরি করিনাই…ওইডা আমার ট্যাকা…আপনি আমারে দুইডা আইচ্ִরিম দেন।

- শুয়রের বাচ্চা কথা কম ক। এই টাকা তোর আমারে মিথ্যা বলস? কইতাছি ভাগ…নয়তো মাইর দিয়া তোর চোর বাপের নাম ভুলায়া দিমু।

- আপনে আমার ট্যাকা ঘুরত দেন। চইলা যাইতেছি।

- আবার কথা কস? এইডা তোর টাকা না। তুই চুরি করছস…এই টাকা তুই পাবিনা। যা ভাগ।

এবার দোকানদারের পা চেপে ধরলো,

- আমার ট্যাকা আমারে দিয়া দেন…আমি আর এইদিকে আসুম না.…দিয়া দেন.…!!

- আমি কিন্তু তোরে এখন পুলিশে দিতে পারি। দাড়া তোরে দেখাইতেছি।

লোকটা রাস্তার পাশে গেলো। গিয়ে ট্রাফিক পুলিশের কানে কানে কি জানি বললো। পুলিশটা মুচকি হাসি দিলো। যাক সকালের বনিটা ভালোই হবে তার।

ট্রাফিক পুলিশটা তার লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে রবিনের সামনে আসলো। বললো,

- মাগীর পোলা, ট্যাকা চুরি করস…আয় এইবার…তোরে দেখাইতেছি মাইর কি জিনিস…

পুলিশটাকে সামনে আসতে দেখে রবিন আর সেখানে থামলো না। দৌড় দিয়ে অন্য যায়গায় চলে গেলো।

একটু পর আবার লুকিয়ে দোকানটার সামনে এলো। দেখলো দোকানদার একটা নোট পুলিশকে দিলো। পুলিশটাও হাসতে হাসতে টাকাটা পকেটে ভরলো। সে শুনতে পেলো দোকানদার বলছে 'হেহেহে…সাতসকালে ভালোই দান মারলাম কি বলেন ভাই?'পুলিশটাও বললো، 'হাহা…তা ঠিক বলেছেন ভাই। সকালটা এরকম ভাগ দিয়ে শুরু করলাম পুরা দিন ভালোই যাবে মনে হচ্ছে'

আর সহ্য করতে পারলো না রবিন। রাগে ওর শরীর কাপতে লাগলো।

রাস্তার পাশ থেকে দুইটা বড় বড় ইটের টুক্রা কুড়িয়ে নিলো। তার হাতের টিপ অনেক ভালো।

প্রথম ইট টা গায়ের জোরে ছুড়ে মারলো পুলিশের মাথায় । 'ওরে মারে!' বলে পুলিশ কপালে হাত দিলো। কপাল কেটে রক্তের ধারা হাত দিয়ে পরতে লাগলো। টলতে শুরু করলো।

দোকানদার কিছু বুঝে উঠার আগেই পরের ইটের টুকরা টা মারলো তার মুখে। ধরাম করে নাকে লাগলো। নাক চেপে ধরে টালমাতাল হয়ে পুলিশের গায়ের সাথে ধাক্কা দিলো। দুজন সশব্দে আছরে পরলো রাস্তার নর্দমায়।


রবিন কি জানি ভাবলো। দোকান থেকে একটা দেয়াশলাই নিলো। দৌড় দিল জান প্রান দিয়ে। ওর একটাই সুবিধা ওকে শহরের কেউ চিনে না।

'এক দৌড়ে পান-মোল্লার বাসায় পৌছালো। এখনো মোল্লা ঘুমাচ্ছে। বাড়ির পাশেই সব কাগজ শুকিয়ে জড় করে রাখা আছে।

দেরী না করে দেয়াশলাই বের করলো। একটা একটা করে কাঠি জ্বালিয়ে কাগজের স্তুপে ছুড়ে মারতে লাগলো। শুকনো কাগজ জ্বলে উঠতে সময় লাগলো না। আগুন ভালো মতো ধরার সাথে সাথে রবিন দৌড় দিলো। ওর একটাই সুবিধা মোল্লা জীবনেও ওকে সন্দেহ করবে না।

এক দৌড়ে টিলার কাছে পৌছুলো। বস্তাটা তুলে নিলো। কাগজ খুটতে শুরু করলো। যেন কিছুই হয়নি।
কিন্তু হচ্ছে!!! ওর মনের ভেতর অনেক কিছু হচ্ছে। রবিন 'হোহোহোহো…'করে অট্টহাসি দিলো। আজকে সে সবচাইতে খুশি।!!

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment