ওয়াশিংটন স্কয়ারের পশ্চিমে এক ছোট জেলা,
যেখানে রাস্তাগুলো অনিরাপদভাবে ছুটে চলেছে এবং ভেঙে ভেঙে নিজেদের
ভিতরে ছোট ছোট ‘গলি’ তৈরী করেছে। এই
গলিগুলোতে গড়ে উঠেছে অদ্ভুত সব
কোণা কানছি আর বাঁক। একটি রাস্তা নিজের
উপর দিয়ে এক দুইবার করে অতিক্রম করে গেছে। একবার এক চিত্রশিল্পী এই
রাস্তাটির মাঝে এক মূল্যবান
সম্ভাবনা আবিষ্কার করে বসলেন। মনে করুন,
একজন সংগ্রাহক রঙ, কাগজ এবং ক্যানভাসের
জন্য বিল সাথে নিয়ে এই পথের
মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎকরে দেখল সে আগের জায়গায়ই ফিরে এসছে, এর জন্য
তাকে এক পয়সাও খরচ করতে হয় নি! তাই, চিত্রশিল্পীরা খুব
তাড়াতাড়ি ঘুরতে ঘুরতে এই অদ্ভুত
পুরনো গ্রিনিচ গ্রামে চলে এল, খুঁজে বের করল
উত্তর দিকের জানালাসহ আঠার শতকের
পুরনো গ্যাবল (ডাচ গ্যাবল জ্যাকোবিয়ান
সময়ের ইংল্যান্ডের বিশেষ স্থাপত্যের বাড়ী), কম ভাড়ায় এক ডাচ চিলেকোঠা। এরপর
তাঁরা ছয় নম্বর এভিনিউ থেকে রান্না করা ও
খাবার গরম রাখার জন্য চুল্লিযুক্ত দুই
একটি পাত্র এবং কিছু পিউটর মগ
নিয়ে এসে এখানে কলোনি গড়ল। তিন তালা পাকা বাড়িটির নীচ তলায় ছিল
সিউ ও জনসির স্টুডিও। ‘জনসি’
জোয়ান্না নামে পরিচিত ছিলেন। একজন
এসেছিল মেইন থেকে, অন্যজন
ক্যালিফোর্নিয়া। আট নম্বর স্ট্রীটের
“ডেলমনিকো’স” হোটেলের খাবার টেবিলে তাঁদের পরিচয় হল
এবং তাঁরা দেখলেন শিল্প, চিকরি সালাদ ও
বিশপ স্লিভ (ফুল হাতার জামা বিশেষ) এ
তাঁদের রূচির অনেক মিল, যার ফলশ্রুতিতে এই
যৌথ স্টুডিওটি দাঁড়িয়ে গেল। সময়টা ছিল মে মাস। নভেম্বরে এক শীতল,
অদেখা আগন্তুক, যাকে ডাক্তাররা ডাকত
নিউমোনিয়া, কলোনিতে জেকে বসল, তাঁর
হিমশীতল আঙুলগুলো এখানে সেখানে স্পর্শ
করল। এই
ধ্বংসকারী দুঃসাহসিকভাবে লম্বা লম্বা পা ফেলে পূর্ব দিকে এগোলেন, তার শিকারকে আঁচড়
বসিয়ে সজোরে আঘাত করলেন, কিন্তু এই সরু ও
শেওলা পড়া গোলক ধাঁধার ‘গলি’ দিয়ে তার
পা আস্তে আস্তে পথ মাড়াল। একজন আদর্শ নাইট, বয়স্ক সজ্জন
ব্যক্তিকে আপনি যা ডাকতে পারেন,
নিউমোনিয়া সাহেব তেমনটি নন।
ক্যালিফোর্নিয়ার মৃদুমন্দ পশ্চিমা বায়ুর
সহানুভূতির পাত্র রক্তশূন্য ছোট মেয়েটি ছিল
লাল মুঠো, স্বল্পস্থায়ী শ্বাস-প্রশ্বাসের নির্বোধ বুড়োটার জন্য নামেমাত্র বৈধ
আক্রমণস্থল। তাই জনসিকে সে সজোরে আঘাত
করে বসল; জনসি বিছানায় পড়ে গেল,
হাঁটা চলা করত না বললেই চলে, নিজের
আলপনা আঁকা লোহার খাটে শুয়ে শুয়ে ছোট ডাচ
জানালার শার্সির কাচের ভিতর দিয়ে সামনের পাকা বাড়িটার শূন্য দিকটায়
চেয়ে থাকত। একদিন সকালে সিউয়ের আমন্ত্রণে উস্কখুস্ক,
ধূসর ভ্রু’র এক ব্যস্ত ডাক্তার
বিল্ডিংয়ে এলেন। “তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দশে এক ”,
ডাক্তার তাঁর ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটারের
পারদ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, “এবং তাঁর
জন্য এই সম্ভাবনাটি হল তাঁর নিজের
বেঁচে থাকার ইচ্ছা। শেষ সীমানায়
পৌছে যাওয়া মানুষ জন এই উপায়েই আবার ফিরে আসে – যে সীমানায় মৃত্যুদূত সমগ্র
ফার্মাকোপিডিয়াকে নিরর্থক
বানিয়ে ফেলে। আপনার এই ছোট
মেয়েটি নিজের মনকে বুঝিয়েছে সে আর সুস্থ
হতে যাচ্ছে না। তাঁর মনে এছাড়া আর
অন্যকিছু আছে কি?” “সে – সে কিছুদিন নেপলস
উপসাগরকে আঁকতে চেয়েছিল।”, সিউ বলল। “চিত্রাঙ্কণ? – নাহ! তাঁর মনে গুরুত্বপূর্ণ
কোনো চিন্তা দুইবার এসেছিল কি – যেমন
ধরুন কোনো মানুষকে নিয়ে?” “কোনো মানুষ?”, জিউ’স হার্পের (এক ধরণের
বাদ্য বিশেষ) টুং টাং শব্দের মত কর্কশ
নাকি সুরে সিউ বলল, “কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ
– কিন্তু, না, ডাক্তার; এমন কিছু হয় নি।” “আচ্ছা, এটাই তাহলে তাঁর দুর্বলতা”,
ডাক্তার বলল। “আমার সামর্থ্যের
মধ্যে যতটুকু সম্ভব, বিজ্ঞান
অনুসারে আমি তার সবটুকুই করব। কিন্তু যখনই
আমার রোগী তাঁর শব যাত্রার দিন গুনতে শুরু
করবে, আমি ঔষধের উপশম-সহায়ক ক্ষমতা অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসবো। নতুন
শীতের ধরনে তাঁর ক্লোক স্লিভে (ফুল হাতার
আলখাল্লা বিশেষ) কেমন
লাগছে যদি আপনি তাঁকে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করতে পারতেন,
আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি তাঁর বেঁচে থাকার
সম্ভাবনা বেড়ে দশে একের পরিবর্তে পাঁচে এক হবে।” ডাক্তার চলে গেলে, সিউ তাঁর
ওয়ার্করুমে গিয়ে নরম
জাপানী ন্যাপকিনে মুখ ঢেকে কাঁদলেন।
এরপর সে তাঁর ড্রয়িং বোর্ড নিয়ে তর্জন
গর্জন করতে করতে জনসির
রুমে গিয়ে সিটি বাঁজিয়ে র্যাগটাইম (১৯২০ এর দশকের নিগ্রোদের জনপ্রিয় গান)
গাইতে লাগলেন। জনসি কাঁথার নিচে বড়ো জোর একটু
নড়াচড়া করে, জানালার দিকে মুখ
করে শুয়ে রইল। সিউ
সিটি বাঁজানো থামিয়ে ভাবলেন,
জনসি ঘুমিয়ে আছে। সে তাঁর বোর্ড সাজিয়ে ম্যাগাজিনের গল্প
ফুটিয়ে তোলার জন্য কলম-কালি দিয়ে চিত্র
আঁকতে শুরু করলেন। একজন নবীন
চিত্রশিল্পীকে শিল্পকলায়
প্রতিষ্ঠা পেতে হলে অবশ্যই ম্যাগাজিনের
গল্পের জন্য চিত্র আঁকতে হয়, যেমন একজন নবীন লেখককে প্রতিষ্ঠা পেতে গল্প
লিখতে হয় ম্যাগাজিনের জন্য। সিউ ঘোড়-দৌড়ে পড়ার জন্য এক জোড়া রুচিশীল
পায়জামা এবং গল্পের নায়ক, এক
ইডাহো (যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য)
রাখালের একপার্শ্বিক চিত্রের স্কেচ
আঁকছিলেন, তখন সে বেশ কয়েকবার
পুনরাবৃত্তিসহ নিচু স্বরের একটি শব্দ শুনতে পেলেন। সে দ্রুত বিছানার
পাশে ছুটে গেলেন। জনসির চোখ পুরোপুরি খোলা ছিল।
সে জানালার বাইরে তাঁকিয়ে গুনছিল –
উল্টো দিক থেকে গননা। “বারো”, সে বলল, এবং অল্প সময় পরে,
“এগারো”; এরপর “দশ”, “নয়”; “আট”, সাত”,
প্রায় এক সাথেই। সিউ উৎকণ্ঠিতভাবে জানালার
বাইরে তাঁকালো। কি আছে সেখানে গোনার
মতো? সেখানে দেখা যাচ্ছিল এক শূন্য,
বিষণ্ণ উঠোন, এবং কুড়ি ফুট দূরে এক
পাকা বাড়ির শূন্য অংশ। একটি পুরনো,
গাঁটযুক্ত ও ক্ষয়ে যাওয়া শিকড়যুক্ত বয়স্ক আইভি লতা ইটের দেয়ালের অর্ধেকটায়
বেয়ে উঠেছিল। পরিত্যক্ত ইটের
দেয়ালে প্রায় শূন্য লতাটির
কাঠামো প্রশাখা দৃঢ়ভাবে লেগেছিল, যতক্ষন
পর্যন্ত না হেমন্তের শীতল
হাওয়া লতাটি থেকে পাতাগুলোকে দুর্বল করে ফেলেছিল। “কি করছো, সোনা?” সিউ জিজ্ঞাসা করল। “ছয়”, প্রায় ফিসফিস করে বলল জনসি।
“ওরা এখন খুব দ্রুত পড়ে যাচ্ছে। তিন দিন
আগেও প্রায় একশটা ছিল।
ওগুলো গুনতে গুনতে আমার
মাথাটা ধরে এসেছিল। কিন্তু এখন সহজ
হয়ে এসেছে। আরেকটা পড়ে গেল। এখন আর মাত্র পাঁচটি বাকি আছে।” “পাঁচটি কি, সোনা? তোমার সিউডিকে বলো?” “পাতা। আইভি লতার। যখন শেষ
পাতাটি পড়ে যাবে, আমিও অবশ্যই
চলে যাবো। তিন দিন হল এটি আমি জেনেছি।
ডাক্তার কি তোমাকে বলে নি?” “ওহ! এই ধরনের অর্থহীন কথা আমি আর
কখনো শুনি নি,” আশ্চর্যরকম অবজ্ঞার
সুরে অভিযোগ করে বলল সিউ। “তোমার সুস্থ
হয়ে যাওয়ার সাথে বুড়ো আইভি পাতার
কি সম্পর্ক? তুমি ঐ লতাকে খুব
বেশি ভালোবেসে ফেলেছো, দুষ্ট মেয়ে। বোকার মত আচরন করো না। কেন, ডাক্তার
তো আজ সকালেই আমাকে বলল তোমার দ্রুত সুস্থ
হয়ে যাবার ভালো সম্ভাবনা আছে –
মনে আছে তোমার, ডাক্তার ঠিক কি বলেছিল –
সে বলল, সম্ভাবনা দশে এক! কেন,
এটা তো প্রায়ই একটি ভালো সম্ভাবনা হতে পাড়ত
যদি আমরা নিউ ইয়র্কে স্ট্রিট
কারে চড়ে ঘুরে বেড়াতাম অথবা একটি নতুন
বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতাম। এখন
কিছুটা স্যুপ খাওয়ার চেষ্টা করো এবং তোমার
সিউডিকে তাঁর ড্রয়িংয়ের কাছে আবার ফিরে যেতে দাও, যাতে সে ওগুলো সম্পাদক
সাহেবের কাছে বিক্রি করে তাঁর অসুস্থ
বাচ্চাটার জন্য পোর্ট ওয়াইন (পর্তুগালের
গাঢ় লাল বা সাদা, উগ্র, মিষ্ট মদ বিশেষ)
এবং নিজের জন্য লোভনীয় শুকরের চপ
কিনতে পারে।” “তোমাকে আর ওয়াইন কিনতে হবে না,”
জানালার বাইরের তাঁর দৃষ্টি স্থির রেখে,
জনসি বলল। “আরেকটা পড়ে গেল। না,
আমি কোনো স্যুপ চাই না। আর মাত্র
চারটা পাতা আছে। অন্ধকার নেমে আসার
আগেই আমি শেষ পাতাটির পড়ে যাওয়া দেখতে চাই। এর পরে আমিও
চলে যাবো।” “জনসি, সোনা,” তাঁর উপর নুয়ে পড়ে সিউ বলল,
“তুমি কি আমাকে কথা দিবে, তোমার
চোখদুটো বন্ধ রাখবে, এবং যতক্ষন পর্যন্ত
আমার কাজ শেষ না হয় তুমি জানালার
বাইরে তাঁকাবে না?
আমাকে ছবিগুলো কালকেই জমা দিতে হবে। আমার আলো দরকার, না হলে আমি পর্দা টেনেই
আঁকতাম।” “তুমি অন্য রুমে গিয়ে আঁকতে পারো না?”
নিষ্প্রাণভাবে বলল জনসি। “আমাকে এখানে তোমার পাশেও থাকতে হবে,”
সিউ বলল। “এছাড়া, আমি চাই না তুমি ঐসব
তুচ্ছ আইভি পাতার দিকে তাঁকিয়ে থাকো।” “তোমার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই
আমাকে বোলো,” ফ্যাকাশে ও ভূপতিত স্ট্যাচুর
মত শুয়ে থেকে, চোখদুটো বন্ধ
রেখে জনসি বলল, “কারন আমি শেষ পাতাটির
পড়ে যাওয়া দেখতে চাই।
আমি অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। আমি ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত। আমি সকল বন্ধন
থেকে মুক্তি পেতে চাই, ক্রমশ
ডুবে যেতে চাই, ঠিক ঐসব নিঃস্ব, ক্লান্ত
পাতাগুলোর মত।” “ঘুমোতে চেষ্টা করো,” সিউ বলল। “বৃদ্ধ
নির্জনবাসী খনি-শ্রমিকের মডেল হবার জন্য
আমাকে বেহরম্যানকে ডাকতে যেতেই হবে।
আমার যেতে এক মিনিটও লাগবে না।
আমি না ফেরা পর্যন্ত নড়াচড়ার
চেষ্টা করো না।” বৃদ্ধ বেহরম্যান ছিলেন একজন পেইন্টার,
যিনি তাঁদের নিচে গ্রাউন্ড
ফ্লোরে থাকতেন। ষাট পেরোনো এই বুড়োর
মাইকেল এঞ্জেলোর ‘মোজেসে’র মত দাড়ি ছিল,
যেন স্যাটারের
মাথা থেকে কোঁকড়িয়ে নিচে নেমে এসেছে এবং দেহখানা খুদে শয়তানের মতো। (ইতালীর বিখ্যাত চিত্রকর ও ভাস্কর
মাইকেল এঞ্জেলোর ভাস্কর্য ‘মোজেস’; দুই
সুশোভিত মার্বেল স্তম্ভের
মাঝখানে মার্বেল চেয়ারে বসা মোজেস, যার
দীর্ঘ দাড়ি কোলের উপরে এসে পড়েছে।
মোজেস ইসলাম ধর্মে মুসা নবী নামে পরিচিত ও ইহুদী ধর্মের প্রবর্তক। স্যাটার গ্রীক ও
রোমান পুরানে উল্লেখিত অর্ধমানব ও
অর্ধপশুরূপী বনদেবতা।) বেহরম্যান
চিত্রশিল্পে ছিলেন ব্যর্থ। চল্লিশ বছর
ধরে ব্রাশ ঘষেও তাঁর গিন্নীর গাউনের
আঁচলের কাছাকাছি কিছু একটা আঁকতে পারেন নি। সে সবসময় তাঁর শ্রেষ্ঠ
চিত্রকর্মটি আঁকার কথা ভাবত, কিন্তু কখনোই
সেটা শুরু করতে পারে নি। বেশ কয়েক বছর
ধরে, কিছু ইতঃস্তত বাণিজ্যিক ও
বিজ্ঞাপনী আনাড়ি চিত্র আঁকা ছাড়া তেমন
কিছুই করতে পারে নি সে। কলোনির নবীন আঁকিয়ে যাদের পেশাদার চিত্রশিল্পীর
মতো অর্থ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাঁদের
মডেল হিসেবে কাজ করে সে অল্প কিছু
উপার্জন করত। সে মাত্রাতিরিক্ত জিন (মদ
বিশেষ) পান করত এবং সবসময় তাঁর আসন্ন
শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মটি সম্পর্কে কথা বলত। বাকিটা সময় সে ছিল একজন
রাগী ছোটখাটো বুড়ো মানুষ, অন্যের স্নেহ-
মমতা পাওয়ার জন্য যে ছিল ক্ষুধার্ত,
এবং নিজেকে গণ্য করেছিল অপেক্ষমান
বিশেষ মাস্টিফ (প্রহরাকাজে দক্ষ, বড়
আকারের শক্তিশালী কুকুর বিশেষ) হিসেবে যে উপরের স্টুডিওটির দুই নবীন
চিত্রশিল্পীকে বাঁচাতে যাচ্ছিলেন। সিউ বেহরম্যানকে তাঁর
অনুজ্জ্বলভাবে আলোকিত আস্তানায়
প্রবলভাবে জুনিপার (চিরসবুজ গুল্ম বিশেষ)
ফলের ঘ্রাণ নিতে দেখতে পেলেন। এক কোণায়
কাঠের ফ্রেমে একটি শূন্য ক্যানভাস
সাজানো ছিল, শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটির রূপ পেতে প্রথম রেখাটির জন্য যা পচিশ বছর
ধরে অপেক্ষা করে আছে। সিউ
বেহরম্যানকে জনসির অবাস্তব কল্পনার
কথা বলল, বলল কতটা শঙ্কিত দেখাচ্ছে তাঁকে,
নিজেকে তুচ্ছ ও ঠুনকো পাতার মত ভাবছে,
ভেসে চলে যাচ্ছে দূরে, পৃথিবীর প্রতি তাঁর ক্ষুদ্র বন্ধন ক্রমশ দুর্বলতর হচ্ছে। বুড়ো বেহরম্যানের রক্তিম চোখদুটোতে অশ্রুর
বন্যা বেয়ে গেল, সে চেঁচিয়ে এই নির্বোধ
ধরনের কল্পনাকে অবজ্ঞা ও উপহাস করল। “ধুর!” সে কেঁদে ফেলল। “পৃথিবীতে এমন লোকও
আছে, যারা তাঁদের নির্বুদ্ধিতার জন্য
মারা যাবে, এক দুর্দশাগ্রস্ত
লতা থেকে পাতাগুলো ঝরে পড়ে যাচ্ছে এই
কারনে? আমি এই ধরনের
কথা আগে কখনো শুনি নি। না, আমি আপনার বোকা নির্জনবাসী – নির্বোধ ব্যক্তির
মডেলের পোজ দিতে পারব না। এই ধরনের
বোকাটে কারবার কেন আপনি তাঁর মাথায়
আসতে দিলেন? আহ, বেচারা ছোট্ট মিস
জনসি।” “সে এখন খুবই অসুস্থ ও দুর্বল,” সিউ বলল, “
এবং জ্বর তাঁর মনটাকে অসুস্থ করে দিয়েছে,
আজব সব অবাস্তব কল্পনায় তাঁর মন
ভরে উঠেছে। খুব ভালো, বেহরম্যান সাহেব,
যদি আপনি আমার জন্য পোজ দিতে না চান,
আপনাকে প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি একজন কুৎসিত বুড়ো – গল্পগুজবপ্রিয়
বুড়ো ফচকে।” “আপনিও আর দশটা মেয়ে মানুষের মতো!”
চেঁচিয়ে উঠল বেহরম্যান। “কে বলল আমি পোজ
দিব না? চলুন। আমি আপনার সাথে যাচ্ছি।
আধা ঘন্টা ধরে আপনাকে আমি বলার
চেষ্টা করছি, পোজ দিতে আমি প্রস্তুত। হায়
ইশ্বর! এমন কোনো জায়গা থাকতে পারে না যেখানে মিস
জনসির মতো একজন ভালো মানুষকে অসুস্থ
হয়ে পড়তে হবে। একদিন আমি আমার শ্রেষ্ঠ
চিত্রকর্মটি আঁকব, এবং একদিন আমাদের
সবাইকে চলে যেতে হবে। হায় ইশ্বর! হ্যাঁ।” তাঁরা উপরের তলায় যখন গেল, জনসি তখন
ঘুমোচ্ছিল। সিউ জানালার চৌকাঠ পর্যন্ত
পর্দা টেনে দিয়ে বেহরম্যানকে ইশারা করে অন্য
রুমে যেতে বলল। সেখানে তাঁরা ভয়ের
সাথে জানালার
বাইরে উকি দিয়ে আইভি লতাটিকে দেখল। এরপর তাঁরা নিশ্চুপ থেকে কিছু সময়ের জন্য
একে অপরের দিকে তাঁকালো। তুষারপাতসহ
অবিরামভাবে শৈত্য বৃষ্টি পড়ছিল।
বেহরম্যান তাঁর পুরনো নীল
শার্টটি গায়ে চড়িয়ে, উল্টে রাখা কেটলির
উপর অবিচলিতভাবে নির্জনবাসী খনি – শ্রমিকের মত বসে পড়ল। পর দিন সকালে সিউ যখন তাঁর এক ঘন্টার ঘুম
থেকে জেগে উঠল, জনসিকে দেখতে পেল মলিন,
পুরোপুরি খোলা চোখ নিয়ে এক
দৃষ্টিতে টেনে দেয়া সবুজ পর্দাটার
দিকে তাঁকিয়ে আছে। “এটাকে উপরে টেনে দাও; আমি দেখতে চাই,”
জনসি ফিসফিসিয়ে নির্দেশ দিল। সিউ ক্লান্তভাবে নির্দেশ পালন করলেন। কিন্তু, দেখুন! সারা রাত ধরে তীব্র বৃষ্টিপাত
ও আকষ্মিক প্রবল ঝড়ো হাওয়া সহ্য করার
পরেও, ইটের
দেয়ালে একটা আইভি পাতা তখনো টিকে আছে।
এটা ছিল লতাটির শেষ পাতা। কান্ডের
কাছে এটি এখনো গাঢ় সবুজ; মলিন ও ক্ষয়ে যাওয়া খাঁজ কাটা হলুদ প্রান্ত নিয়েও
মাটি থেকে কুড়ি ফুট উপরে এক প্রশাখার
সাথে চমৎকারভাবে ঝুলে আছে। “এটাই শেষ পাতা,” জনসি বলল,
“আমি ভেবে ছিলাম, এটা নিশ্চিতভাবেই কাল
রাতে পড়ে গেছে। আমি বাতাসের শব্দ
শুনেছিলাম। এটা আজকে পড়ে যাবে, এবং তখন
আমিও মরে যাবো।” “সোনা, সোনা!” সিউ তাঁর মলিন
মুখখানা বালিশে চেপে বলল,
“যদি তুমি তোমার কথা ভাবতে না চাও,
তবে আমার কথা ভাবো। তাহলে আমি কি করব?” কিন্তু জনসি কোনো উত্তর দিল না।
একটি আত্না যখন তাঁর রহস্যময়, দূরের
যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নেয়, তখন
এটি হয়ে দাঁড়ায় পৃথিবীর
মধ্যে সবচেয়ে বেশি একাকী আর দুঃখকাতর
কোনো অস্তিত্ব। অবাস্তব কল্পনা তাঁর মাঝে এত প্রবলভাবে ভর করে যেন সব ধরনের
বন্ধন যা তাঁকে বেঁধে ছিল বন্ধুত্বের মাঝে,
পৃথিবীর সাথে, এক এক করে মুক্ত হয়ে যায়। দিন পেরিয়ে গেল, এমনকি গোধূলির সময়ও
তাঁরা নিঃসঙ্গ আইভি পাতাটিকে দেয়ালের
উপর তার কান্ডের
সাথে দৃঢ়ভাবে এঁটে থাকলে দেখল।
এবং এরপর, রাত নেমে এলে উত্তরীয়
হাওয়া আবার বইতে শুরু করল, জানালার উপর বৃষ্টি আছড়ে পড়ল সেদিনও এবং ছাদের
সামনের দিকের নিচু অংশ দিয়ে টিপটিপ
করে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ল। যখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল,
হৃদয়হীনা জনসি পর্দাটিকে উপরে টেনে দিতে আদেশ
দিল। আইভি পাতাটি তখনো সেখানে ছিল। জনসি বিছানায় শুয়ে দীর্ঘ সময় ধরে এটার
দিকে তাঁকিয়ে থাকল। এরপর
সে সিউকে ডাকল, সিউ তখন গ্যাসের চুল্লীর
উপর রাখা চিকেন স্যুপকে চামচ
দিয়ে নেড়ে দিচ্ছিল। “আমি খারাপ মেয়ে হয়ে গেছি, সিউডি,”
জনসি বলল, “কোনো একটা কারনে শেষ
পাতাটি সেখানে থেকে গিয়ে আমাকে দেখাচ্ছে কতটা মন্দ
আমি। মরতে চাওয়াটা পাপ। তুমি আমাকে অল্প
একটু স্যুপ এনে দাও, আর কিছু পরিমান দুধের
সাথে অল্প একটু পোর্ট ওয়াইন, আর – না; প্রথমে তুমি আমার জন্য একটা হাত-
আয়না নিয়ে আসো, এর পর আমার কিছু বালিশ
জড়ো করো, আমি এর উপর বসে তোমার
রান্না করা দেখব।” এবং ঘন্টাখানেক পর সে বললঃ “সিউডি,
আশা করি এক দিন আমি নেপলস
উপসাগরকে আঁকতে পাড়ব।” ডাক্তার বিকেলের দিকে এল, এবং সিউ ওজর
দেখিয়ে ডাক্তারের সাথে বারান্দার
দিকে গেল। “এমনকি সুযোগ পেলে,” ডাক্তার সিউয়ের সরু
হাত নিজের হাতের মুঠোয়
নিয়ে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল,
“ভালো সেবা দিয়ে আপনি জয়ী হবেন।” “এখন
আমাকে নীচতলার আরেকজন রোগীকে অবশ্যই
দেখতে যেতে হবে। বেহরম্যান,তাঁর নাম – এক প্রকার চিত্রশিল্পী বলতে পারেন,
আমি বিশ্বাস করি, তাঁরও
নিউমোনিয়া হয়েছে। সে একজন বুড়ো, দুর্বল
মানুষ, এবং আক্রমণটাও খুব মারাত্নক। তাঁর
বেঁচে থাকার কোনো আশা নেই; তবুও সে আজ
হাসপাতালে গিয়েছে আরো অধিক আরামবোধ করার জন্য।” পরের দিন ডাক্তার সিউকে বলল, “সে এখন
বিপদমুক্ত। আপনি জিতে গেছেন। পুষ্টিকর
খাবার আর যত্ন – এখন শুধু এইটুকুই যথেষ্ট।” জনসি যে বিছানায় শুয়েছিল সিউ সেই
বিকেলে সেখানে এল, একটি গাঢ় নীল
এবং ব্যবহারের একেবারেই অযোগ্য উলের
তৈরী কাঁধের স্কার্ফ মনের আশ
মিটিয়ে সেলাই করতে লাগল এবং অন্যহাত
দিয়ে জনসি, তাঁর বালিশ এবং চারপাশে বুলাতে লাগল। “আমার সাদা ইঁদুর, তোমাকে কিছু বলার
আছে আমার,” সিউ বলল, “বেহরম্যান সাহেব
আজ হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় মারা গেছে।
সে মাত্র দুই দিন অসুস্থ ছিল। প্রথম দিন
সকালে দাঁড়োয়ানেরা তাঁকে নীচতলায় তাঁর
রুমে অসহায়ভাবে ব্যাথায় কাঁতারানো অবস্থায় পেয়েছিল। তাঁর জুতো ও
কাপর–চোপড় ছিল ভেজা এবং বরফ শীতল।
তারা কল্পনাও করতে পারে নি ঐ ভয়ঙ্কর
রাতে সে কোথায় ছিল। এরপর
তারা একটি লণ্ঠন দেখতে পেল,
সেটা তখনো জ্বলছিল, এবং আর একটি মই যেটি এখান থেকে টেনে নেওয়া হয়েছিল, আর
কিছু ইতস্তত ছড়ানো ব্রাশ এবং একটি প্যালেট
(চিত্রশিল্পীদের রঙ গোলা ও মেশানোর জন্য
ব্যবহৃত বোর্ডবিশেষ) যার উপর সবুজ এবং হলুদ
রঙ মেশানো হয়েছিল – জানালার বাইরের
দিকে দেয়ালের উপর শেষ আইভি পাতাটার দিকে একটু তাঁকাও, সোনা। তুমি কি একটুও
বিস্ময়াভিভূত হও না কেন বাতাস
বয়ে গেলে এটি দোলে না বা নড়াচড়া করে না?
ওহ সোনা! এটাই বেহরম্যানের
শ্রেষ্ঠচিত্রকর্ম – শেষ পাতাটি পড়ে যাবার
পর সেদিন রাতে সেখানে সে এটি এঁকেছে।”
অনুসন্ধান করুনঃ
ফেসবুকে যোগ দিনঃ
হৃদয়ের অন্তস্থল থেকেঃ
জনপ্রিয় লেখাঃ
বিভাগঃ
- ই বুক (12)
- ইসলামিক (24)
- ওয়েব ডিজাইন (15)
- কবিতা (6)
- গল্প (11)
- গান (6)
- গিনেস বুক অফ ওয়াল্ড রেকডস (20)
- জীবনি (3)
- টিপস এন্ড ট্রিকস (41)
- টেক সংবাদ (62)
- ডাওনলোড (3)
- তথ্য প্রযুক্তি (9)
- প্রাণী বৈচিত্র্য (31)
- ফান জোন (3)
- বিস্ময়কর তথ্য (2)
- মোবাইলীয় (46)
0 মন্তব্য(সমূহ):
Post a Comment